Photo: collected
পর্যটনের নিজস্ব একটি ভাষা আছে। এ ভাষা ইংরেজি নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দাপুটে ভাষা, যেমন- স্প্যানিশ, ফ্রেন্স বা বিপুল জনগোষ্ঠীর ভাষা আরবি বা চাইনিজ নয়। এ ভাষা পর্যটনের ভাষা। সফল পর্যটন ভাষার উপরে কিছুটা নির্ভর করে, কিন্তু একেবারে নির্ভরশীল হয়ে পড়েনা।
বিশ্বব্যাপী বাৎসরিক পর্যটনের তালিকা যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে তালিকাটি মোটামুটিভাবে নিম্নরূপঃ ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইটালি, তুরস্ক, মেক্সিকো, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রিয়া, গ্রিস, হংকং, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস (তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া, faranwide.com, worldpopulationreview.com)। ভুলে গেলে চলবে না, এ দেশগুলো ভৌগলিকভাবে পৃথিবীর এক জায়গায় যেমন অবস্থিত নয়, তেমনিভাবে দেশগুলোর সংস্কৃতি এবং আয়তন প্রবলভাবে আলাদা। পর্যটন স্থানের প্রতুলতা বা ট্যুরিস্ট স্পটের কথা যদি বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলেও উল্লিখিত দেশসমুহের যথেষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। এ আলোচনার বিষয়বস্তু যেহেতু ভাষাগত ভিন্নতা বনাম সফল পর্যটন, আমরা অত্র আর্টিকেলে বিশেষত সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
ভৌগলিক দিক বিবেচনায়, একটি দেশের পর্যটন মূলত দুই প্রকারঃ ইন্টারন্যাল বা ডমেস্টিক, এবং ইন্টারন্যাশন্যাল বা ক্রস বাউন্ডারি ট্যুরিসম। আমাদের বাংলাদেশে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে ইন্টারন্যাল ট্যুরিসম অনেক বেশি। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হলো মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রজন্মের পর্যটন সচেতনতা। আজকের আলোচ্য বিষয়- ‘পর্যটনের নিজস্ব ভাষা’ ইন্টারন্যাল ট্যুরিসমের জন্যও কিছুটা প্রযোজ্য। কিন্তু, এটি সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক ইন্টারন্যাশন্যাল ট্যুরিসমের ক্ষেত্রে। এখন প্রশ্ন হলো পর্যটনের ভাষা বলতে আমরা ঠিক কি বুঝাচ্ছি। পর্যটনের ভাষা কিছুটা মূর্ত, কিছুটা বিমূর্ত। এটি অনেকটাই সামগ্রিক একটি বিষয়। এর কিছুটা ভাষা, কিছুটা পর্যটন বিষয়ক জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গী, কিছুটা কালচার বা সংস্কৃতি। সহজ কথায় বলতে গেলে পর্যটনের ভাষা হলো একজন পর্যটক (বিশেষত অন্তর্জাতিক পর্যটক) একটি দেশ বা সংস্কৃতিতে ভ্রমণকালীন কেমন বা কতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এই স্বাচ্ছন্দ্যবোধের স্থানে ভাষা অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। যারা বিদেশে গিয়ে ভাষাগত জটিলতার কারণে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তারা নিশ্চয় এটি জানেন।
কিন্তু, আপনি অবধারিতভাবে জেনে রাখতে পারেন, একটি পর্যটন খ্যাতিবহুল দেশে আপনি শুধুমাত্র ভাষার কারণে খুব উল্লেখযোগ্য কোন সমস্যায় পড়বেন না। আর কারণটি বহুবিধ, কিন্তু একই সূত্রে গাঁথা। আর এটিই আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু।
আমাদের অনেকের মধ্যে ধারণা রয়েছে যে, ভালো ইংরেজি না জানলে দেশ-বিদেশ ঘোরা যায় না; এমনকি বিদেশি কাস্টমারকে সার্ভও করা যায়না- যে কারণে আমাদের মধ্যে এক ধরণের প্রচ্ছন্ন ভীতি কাজ করে। আমরা যখন দেশীয় পর্যটন বিকাশ নিয়ে ভাবি, সভা-সেমিনার করি- আমরা বেশ ঢালাওভাবে বলি, বিদেশী পর্যটককে সেবা প্রদানকারীদের ইংরেজি জানতে হবে। বিষয়টি ভুল নয়, তবে মূখ্যও নয়, বা তার কাছাকাছিও নয়।
বিশটি প্রথম সারির পর্যটন সফল দেশের বিষয় যদি ভৌগলিক ও ভাষাগত দিক থেকে ব্যবচ্ছেদ করা হয়- এর মধ্যে ইউরোপিয়ান দেশ ১১ টি (তুরস্ক ধরলে ১২ টি), উত্তর/ মধ্য আমেরিকান দেশ ৩ টি, এশিয়ান দেশ ৬ টি। কোন আফ্রিকান বা ল্যাটিন আমেরিকান এ ২০ টির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নেই, যদিও ল্যাটিন আমেরিকায়ব বিরাট একটি স্প্যানিশ ভাষা বেইজ রয়েছে। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো এ দেশসমূহের অনেকগুলোই (বিশেষ করে ইউরোপিয়ান গুলো, ক্ষেত্রবিশেষে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড) আয়তনের দিক দিয়ে বিশাল নয়; পাশাপাশি তাদের ফার্স্ট ল্যাংগুয়েজ ইংরেজি বা অন্য কোন ভাষা যা বিপুল সংখ্যক মানুষের কথ্য ভাষা তাও নয়। ইটালি, পর্তুগাল, গ্রিস, জার্মানি, নেদারল্যান্ড ভাষাগত দিক থেকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের তুলনায় খুব বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না; তাদের স্থানীয় মানুষ ইংরেজিতে খুব ভালো তাও নয়। অনেক ক্ষেত্রে পর্যটকেরা ইংরেজি মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। কিন্তু অভিভূত হবার মত বিষয় হলো যে, পর্যটকেরা এসব দেশে শুধুমাত্র ভাষার কারণে উল্লেখযোগ্য কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়না। তাহলে কিসের প্রভাবে এমনটি হয়? হ্যা, আপনি অবশ্যই বলবেন- বিষয়টি সামগ্রিক- যেমন নিরাপত্তা, পর্যটনের পরিবেশ, কাঙ্খিত সেবা প্রাপ্তি, পর্যটন ব্যয় ইত্যাদি। বিষয়টি অবশ্যই সামগ্রিক, তবে ভাষার (পর্যটনের ভাষা) এক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমরা সেটিই এ আলোচনায় বিশ্লেষণ করতে চাই।
থাইল্যান্ড একটি দক্ষিণ এশীয় দেশ হবার পরেও বিশ্বের অষ্টম পর্যটন-সফল দেশ। অন্যান্য কারণ আপাততঃ বিবেচনায় না নিয়ে যদি ভাষার দিকে তাকাই- থাইল্যান্ডের মানুষ ইংরেজি প্রায় জানেই না, অনেক ক্ষেত্রেই ইংরেজি সব জায়গায় ঠিকমত লেখা থাকে না। কিন্তু, চেইন সুপার শপের উপস্থিতির কারণে পর্যটকেরা অন্তত এইটুকু স্বস্তিতে থাকতে পারে যে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো দামাদামি বা বারগেইনিং ছাড়াই তারা কিনতে পারবে। খাবারের দোকানগুলিতে দাম ও ছবি ডিসপ্লে করা থাকে, যাতে করে প্রথমত পর্যটকের ঠকার সম্ভাবনা না থাকে, দ্বিতীয়ত তাদের সাথে বেশি কথা বলার প্রয়োজনই না পড়ে। এই বাইরে প্রয়োজন হলে তারা কমিউনিকেটিভ ইংরেজি তে কাজ চালিয়ে নিতে পারে। সবচেয়ে ইন্টারেসটিং বিষয় হলো- এই কমিউনিকেটিভ ইংলিশ অত্যন্ত বেসিক পর্যায়ের- অনেকটা ইয়েস, নো, ভেরি গুডের মত। কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছেলে-মেয়েরা সুপার শপ, অন্যান্য দোকান চালাচ্ছে। আপনি যে জিনিস খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না- কিছুক্ষণ কথা বলার পরে তারা বুঝবে, এবং স্মিত হাস্যে বলবে – ‘no have’ (অর্থ হলো যে- they don’t have that product), উচ্চারণ একেবারেই ঠিক নেই, ব্যকরণগত দিকে থেকেও ভু্ল। তারপরেও তারা বুঝাতে সফল। দামাদামি করলেও খুবই কমিউনিকেটিভভাবে সেটি হয়ে যায়।
‘How much?’
‘100 Bath.’
‘That’s too much. 80 Bath?’
‘No’
এ পর্যায়ে আপনি যদি চলে যেতে উদ্যত হন, পেছন থেকে হয়তে নাইনটি বাথ বলে ডাকবে, অথবা আপনাকে সরি বলে দিবে। তারা খুবই প্রফেশনাল। সরি বলবে বিরক্তি নিয়ে নয়, বরং সহাস্যে। পাশাপাশি, কাপড়ের- ব্যাগের দোকানী, স্কুটি ভ্রাইভার- যেক্ষেত্রে মূল্য প্রদর্শন করা থাকে না, তারা সাধারণত নেটিভদের চেয়ে আপনাকে বেশি চার্জ করবে না (টুকটাক ব্যতিক্রম রয়েছে, যেটি একজন পর্যটককে উল্লেখযোগ্য সমস্যায় ফেলে না)।
ইউরোপের ছোট দেশ ইটালি (ইউরোপের অধিকাংশ দেশের অয়তন খুব বেশি নয়) বিশ্বের পঞ্চম পর্যটন-সফল দেশ। ইটালিততে মানুষ খুব একটা ইংরেজি জানে না। আপনি শুরুর দিকে ভাষাগত কারণে একটু সমস্যায়, বিশেষ করে কোন লোকেশান চেনার জন্য, পড়তে পারেন। কিন্তু গুগল ম্যাপ ইত্যাদি ও ভালো পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশান এর কারণে এটি স্থায়ী হবেনা। আপনি যদি ইটালির নেটিভদের কিছু জিজ্ঞাসা করেন, তারা যতটুকু ইংরেজি জানে ততটুকু দিয়েই আপনাকে বোঝানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে; সে নিজে না পারলে পাশে থাকা কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকে দিয়ে আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে, এবং করবে খুবই আন্তরিকভাবে যাতে করে আপনি মুগ্ধ হবেন। তারা কথা বলতে গিয়ে ইংরেজি- ইটালিয়ান মিশ্রণ করে ফেলবে, কিন্তু তাদের শারীরিক ভাষার কারণে আপনি তা বুঝতে পারবেন।
‘Should I go to the platform number 1?’
তারা মাথা ঝাঁকিয়ে বলবে- ‘Si’ ( si মানে যে yes আপনি অনায়াসে বুঝতে পারবেন)।
আগেই আলোচনা করেছি যে, অনেক পর্যটন সফল দেশই ইংরেজি বা বড় অন্য কোন ভাষায় সাবলীল না হয়েও কি অনায়াসেই না এ সেক্টরে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করে চলেছে! সার কথা যদি বলতে চাই- পর্যটনের এ ভাষা কোন একক ভাষা নয়, এটি একটি শারীরিক ভাষা যা কিছুটা একটি প্রভাবশীল ভাষার কমিউনিকেটিভ অংশকে গ্রহণ করে। আলোচনা কেন্দ্রীভূত করার উদ্দেশ্যে যদি অন্যান্য বিষয়গুলিকে বিবেচনা না করি, পর্যটনের এ ভাষার ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে- বিদ্যমান সামাজিক মূল্যবোধ, একটি দেশের ঔতিহাসিক ও চলমান সংস্কৃতি এবং পারষ্পারিক শ্রদ্ধাবোধ। মজার বিষয় হলো যে, পুরো বিষয়টি কোন একটিভ বা কনসাস্ প্রসেস নয়, ববং অবচেতন বা সাবকনসাস্ প্রক্রিয়া।
আমরা এই প্রক্রিয়া কে একদিন ধরতে পারব, এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশ পর্যটনের নিজস্ব এ ভাষাকে অনুধাবন করে অনেকদূর এগিয়ে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।