
কক্সবাজারের টেকনাফের সাগর উপকূল দিয়ে মানবপাচারকারী চক্রের ১০০ জনকে পাচারের একটি মিশন ব্যর্থ করে দিয়েছে বিজিবি। টানা ১৪ দিনের গোয়েন্দা নজরধারী এবং নিজস্ব কৌশলে পাচারকারি চক্রের ১২ জন এবং ১১ নারী, শিশু পুরুষকে উদ্ধারের পর এই মিশনটি ব্যর্থ হয়েছে। যারা মঙ্গলবার উপকুলের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার হয়ে মালয়েশিয়ায় পাচারের চেষ্টা করে ছিল।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত টেকনাফের গহীন পাহাড়ে পাচারকারিদের আস্তানাসহ কয়েকটি স্থানে এই অভিযান চালানো হয়।
এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বিজিবির টেকনাফস্থ ২ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বিস্ময় প্রকাশ করে জানিয়েছেন, টেকনাফের কচ্ছপিয়া এলাকার গহীন পাহাড়ে অভিজাত ভবন করে ব্যবহার করা হচ্ছে আস্তানা হিসেবে। রয়েছে বিদ্যুৎ সুবিধাও। এই গহীন পাহাড়ে কোন প্রকাশ মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকলেও পাচারকারি চক্রের সদস্যরা ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছেন। ডিভাইজ টু ডিভাইজ সংযুক্তের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ করা হয় মানবপাচার।
আটকরা হলেন, টেকনাফের তুলতুলি এলাকার মৃত হোসেন আহমেদের ছেলে মো. আব্দুর রশিদ (৩৫), একই এলাকার মৃত জগির আহমদের ছেলে মো. জাহেদ (১৮), লেঙ্গুর বিলের নুর বশরের ছেলে মিজানুর রহমান (২০), উখিয়ার থাইংখালী ১৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মো. আইয়ুবের ছেলে মো. আবু তৈয়ব (২৫), মিয়ানমারের বুচিডং এর নুর মোহাম্মদের ছেলে মো. ইদ্রিস (৩৫), দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার মৃত রশিদ উল্লাহর ছেলে মো. জুবায়ের (৩৩), কচ্ছপিয়া এলাকার নুর মোহাম্মদের ছেলে নুরুল আবছার (১৮), ছোট হাবির পাড়ার মৃত সহোরাবের ছেলে মো. ইসমাইল (৩২), বড় ডেইল এলাকার মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে মো. ইমরান (২৮), কচ্ছপিয়া এলাকার নুর ইসলামের ছেলে নুর মোহাম্মদ (৪০), ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মো. জহিরের ছেলে মাহমুদ উল্লাহ (৩০), কচ্ছপিয়ার নুর মোহাম্মদের স্ত্রী খুরশিদা বেগম (৩৪)।
বুধবার বিকালে টেকনাফ বিজিবির দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান জানান, বিজিবির গোয়েন্দাদের মালয়েশিয়াগামি সাজিয়ে মানবপাচারকারি চক্রের সুনিদিষ্ট তথ্য শনাক্ত করা হয়। এর প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে শুরু করা হয় বিজিবির অভিযান। মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন কচ্ছপিয়া এবং বড়ইতলি এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় ১২ জনকে। উদ্ধার করা হয় ১১ জন।
তিনি বলেন, আটক কয়েকজনের দেয়া তথ্য এবং ব্যাটালিয়ানের নিজস্ব গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বেশ কিছু দিন যাবত কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার হয়ে মালয়েশিয়া পর্যন্ত মানব পাচার ও মাদক পাচারের মতো জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িত।
টেকনাফের হোসেন, সাইফুল এবং নিজামের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ চক্রের মূল হোতারা বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় ও দলে বিভক্ত হয়ে এই মানব পাচার করে থাকে। বাংলাদেশে অবস্থানরত কিছু মাঠ পর্যায়ের বেতনভুক্ত সদস্য মালয়েশিয়ায় যাত্রী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রলোভন প্রদর্শন করে। এসব প্রলোভনের মধ্যে রয়েছে উচ্চ বেতনের চাকরি, সুবিধাজনক কর্মসংস্থান, দ্রুত ধনী হওয়ার স্বপ্ন, অল্প খরচে বিদেশ যাত্রা এবং বিনা অর্থে প্রেরণ করে পরবর্তীতে কর্মস্থলে কাজের মাধ্যমে খরচ পরিশোধের সুযোগের প্রতিশ্রুতি।
এ ধরনের প্রলোভনের মাধ্যমে টেকনাফসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের নাগরিকদের মালয়েশিয়া গমনে উদ্বুদ্ধ করা হয়। পরবর্তীতে সংগৃহীত যাত্রীদের তথ্য মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত মূল হোতাদের নিকট প্রেরণ করা হয় এবং তাদের নির্দেশ অনুযায়ী যাত্রীদের স্থানীয় পাচারকারীর নিকট হস্তান্তর করা হয়, যাদের সাথে মাঠ পর্যায়ে লোক সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত পাচারকারীদের বিদেশে পাচারের জন্য কোন যোগাযোগ থাকে না।
নতুন পাচারকারীদের নিকট হস্তান্তরের পর যাত্রীদের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ও গোপন আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে পৌঁছার সাথে সাথে তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও নগদ অর্থ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আবাসিক অবস্থায় ভুক্তভোগীদের পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা হয় না; অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মিতভাবে স্বল্প পরিমাণ খাদ্য প্রদান করা হয়। পরে মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন উপকূল হতে ছোট ছোট নৌযানে করে যাত্রীদের গভীর সমুদ্রে অপেক্ষারত বড় নৌযানে স্থানান্তর করা হয়। যেখানে আটকে রেখে আদায় করা হয় মুক্তিপণ এবং চালানো হয় নির্যাতন।
বিজিবি অধিনায়ক জানান, এ অভিযানে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী বেশ কয়েকটি চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই চক্রের পাঁচজন মূলহোতা মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে থাকেন। থেকে তাদের স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে মানব পাচারের কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
এ ঘটনায় হোসেন, সাইফুল এবং নিজামকে পলাতক আসামি করে আটক ১২ জনের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মামলা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
টিএইচ