ঢাকা,

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫


সংশোধিত আইনে ‘‘বাধ্যতামূলক’’ বিষয়টির উল্লেখ থাকাই মানবাধিকার লংঘন

বিজনেস আই রিপোর্ট

প্রকাশিত হয়েছে: ২২:৪৫, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আপডেট: ২৩:০৩, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সংশোধিত আইনে ‘‘বাধ্যতামূলক’’ বিষয়টির উল্লেখ থাকাই মানবাধিকার লংঘন

দেশের নারীরা কতজন যৌতুকের কারণে সাধারণ জখম হলে কতজন কোর্টে মামলা করতে যায়? মামলার পরবর্তী সময়ের হেনস্থা ও হয়রানির ভয়ে অনেকে মামলা করতে চায় না।

অন্যদিকে সংশোধিত আইনে ‘‘বাধ্যতামূলক’’ বিষয়টির উল্লেখ থাকাই মানবাধিকার লংঘন, এটি নারীর বিচার প্রাপ্তির পথকে সংকুচিত করবে। যৌতুকের মামলায় বাধ্যতামূলক মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার বিধানের বিষয়টি নিয়ে সংশোধিত আইনটি  নারীর জন্য বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে কতটা সহায়ক হবে? অপরাধীদের অপরাধ করার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।

আজ ১৭ সেপ্টেম্বর  (বুধবার) বিকাল সাড়ে ৩ টায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে  মতবিনিময় সভায় বিশিষ্টজনেরা মন্তব্য করেন। 

উক্ত মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট-এর আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ; বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অব:), আইন বিশ্লেষক ও গবেষক ফউজুল আজিম। সভায় অনলাইনে যুক্ত হন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তসলিমা ইয়াসমিন।

স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। সংগঠনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম। মুক্ত আলোচনায় উপস্থিত আইন বিশেষজ্ঞ, আইনজীবীবৃন্দ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।

সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন,  আইনের প্রণয়নের সাথে সাথে বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। নারীর মানবাধিকারের ক্ষেত্র সকল দিক থেকে সংকুচিত হয়ে আসছে, এই অধ্যাদেশ সেটিকে আরো বাড়িয়ে দিবে। নারী আন্দোলনকে নারীর মানবাধিকার  আইনের ক্ষেত্রকে আরো বিস্তুৃত করতে, ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। নারীর জন্য আইন কে নারীবান্ধব করে তুলতে হবে।

স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, বাস্তবতা, দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে  যৌতুক এবং যৌতুকের জন্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন প্রণীত হয়েছিলো। যৌতুক দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিলো। নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটিকে বাধ্যতামূলকভাবে আপোষযোগ্য করা হয়েছে। এটা নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একধরনের পিছনে ফিরে যাওয়া।

বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বলেন, যৌতুক দাবি ও যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় বাধ্যতামূলক মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার বিধানের ফলে  বিচার চাইবার ক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতা শুরু হবে এবং সেখানে বৈষম্য আসবে। এটি সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক।  সিডও এর ৩৩ নম্বর সনদ অনুসারে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার কোনো নারীকে জোর করে আপোষে যেতে বাধ্য করা যাবেনা, এই বক্তব্যের সাথে অধ্যাদেশটি সাংঘর্ষিক। একটি সভ্য সমাজে আইন থাকবে, আইনের অপপ্রয়োগ ঠেকাতে সকলকে সমস্বরে জোরালো দাবি তুলতে হবে

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অব:), আইন বিশ্লেষক ও গবেষক ফউজুল আজিম বলেন, এই অধ্যাদেশের ফলে যৌতুক বিষয়ক কোন মামলা সরাসরি আদালতে করা যাবেনা। ভুক্তভোগীতে চাইতে হবে আপোষে নিষ্পত্তি।  এটা কতটুকু যৌক্তিক ?।   বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনাপূর্বক পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অ্যাড. এস এম এ সবুর বলেন, বিচার পাওয়া  ও বিচার দেওয়া মৌলিক অধিকার।  মামলার আগে নিষ্পত্তি করতে হবে? এটি  চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। স্বাধীন দেশে কম খরচে, স্বল্প সময়ে ন্যায় বিচার প্রাপ্তি আমাদের প্রত্যাশা।

অ্যাড. জাহিদুল বারী বলেন, মোট ৯ টি আইনের বিষয়ের এই প্রক্রিয়ায় মামলা আরো দীর্ঘায়িত হবে। মধ্যস্থতা  বাধ্যতামূলক করার ফলে আইনের নূতন গ্যাপ তৈরি হবে,  মামলার আলামত নষ্ট হবে, জটিলতা তৈরি হবে।

তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, যৌতুক দাবি, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের মামলা বর্তমান আইনে আপোষযোগ্য। এখন বাধ্যতামূলক আপোষের কথা বলা হচ্ছে। কোন কিছু চাপিয়ে দেয়া অনুচিত।

ব্যারিষ্টার এ কে রাশেদুল হক বলেন, জামিন অযোগ্য অপরাধ, বাধ্যতামূূলক মধ্যস্থতার কথা বলা হচ্ছে। মধ্যস্থতা না হলে সেটির প্রভাব নির্যাতনের শিকার নারীর উপর বর্তাবে। সাধারণ জখমের সরাসরি মামলা করা যাবে, যৌতুকের জন্য সাধারণ জখমের মামলা করা যাবেনা- এটা কতটুকু যৌক্তিক।  

ব্যরিষ্টার অমিত দাশগুপ্ত বলেন, আইনী সহায়তা প্রদান আইনের মূল ধারণা থেকে আমরা সরে যাচ্ছি। বাধ্যতামূুলক মধ্যস্থতায় না গেলে মামলা দায়ের করা যাবেনা, এটা মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক।
 
মুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন ব্র্যাকের মিতালী জাহান;   বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির  অ্যাড. সুরাইয়া জামান; নারীপক্ষের ফেরদৌসী আক্তার,  বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের সেলিনা পারভীন; আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে শিল্পী সাহা
সংগঠনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনে  বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম বলেন, যৌতুক প্রতিরোধের জন্য দীর্র্ঘদিন নারী আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যৌতুক প্রতিরোধে আইন পাশ হয়েছে।

আইনে যৌতুককে দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইনে বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানে ২০২৫ সালে যৌতুক এবং যৌতুকের কারণে সাধারণ জখমের বিষয়টি সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বাধ্যতামূলক মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার বিধান যুক্ত করার মাধ্যমে যৌতুকের কারণে সাধারণ জখমের মত অপরাধকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আরো মনে করে, যৌতুক দাবি ও যৌতুকের কারণে সাধারণ জখমের শিকার নারীদের বাধ্যতামূলক মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার বিধান যুক্ত করার মাধ্যমে নারীর ন্যায়বিচারের অভিগম্যতা বাধাগ্রস্থ হতে পারে। আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ,২০২৫ এর ২১(খ) ধারা যুক্ত করে বিচারপ্রার্থী ভুক্তভোগী নারীকে বাধ্যতামূলকভাবে মধ্যস্থতার দিকে ঠেলে দেওয়া তাকে আইন অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। (সংযুক্ত-০১)

উক্ত মতবিনিময় সভায় ব্র্যাক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, নারীপক্ষ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নিজেরা করি, নারী প্রগতি সংঘ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, শক্তি ফাউন্ডেশন এবং গণ সাক্ষরতা অভিযান এর প্রতিনিধিবৃন্দ,  বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীবৃন্দ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেত্রীবৃন্দ এবং  সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা।

টিএইচ

News