অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
১৬৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লাগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব পাকিস্তান জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ রপ্তানি হতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে। তবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুবিধা আনুপাতিক ছিল না। বছরের পর বছর পূর্ব পাকিস্তান আঞ্চলিক ভিত্তিতে ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হওয়ায় গুরুতর অর্থনীতি দৈন্যের সম্মুখীন হয়। যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় ছয় দফা আন্দোলন। দফা আন্দোলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তথা বর্তমান বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা।
ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে তিনি নিজেই ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৬ দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ৬ দফা পেশ করেন। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে 'আমাদের বাঁচার দাবি: ৬ দফা কর্মসূচি শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। ২০ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে মিল রেখে। ৬ দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র। ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। দফা কর্মসূচির ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়। বাংলাদেশের তান্য এই আন্দোলন এতই গুরুত্বপূর্ণ যে একে 'ম্যাগনা কার্টা' বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়।
৬ দফার দাবিগুলো হল: (ক) শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি; (খ) কেন্দ্রীয় সরকারের সমতা, (গ) মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা, (সা) রাজস্ব, কর বা শুপ্ত সম্বন্ধীয় ক্ষমতা; (৪) বৈদেশিক বাণিজ্যবিষয়ক ক্ষমতা (চ) আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা।
ছয় দফার মূল বক্তব্য ছিল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। সরকারের কর, শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকাসহ দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব থাকবে এবং পূর্ববাংলার প্রতিরক্ষা ঝুঁকি কমানোর জন্য এখানে আধা-সামরিক বাহিনী গঠন এ নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করা হবে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনগণের মাঝে ৬ দফা ব্যাপক সমর্থন পায়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ১৬৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের এক সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী। তাঁকে এ ধরনের হয়রানিতে তানগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
৭ জুন আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতার মুক্তির দাবিতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন তথা বাঙালি জাতির মুক্তির ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে পূর্ণ দিবস হরতাল আহ্বান করেছিল। অভুতপূর্বভাবে সে হরতালে সাড়া দেয় ছাত্র-শ্রমিক-জনভাসহ সারা দেশের মানুষ। হরতাল বানচাল করাত পুলিশ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মুক্তিকামী মানুষের মিছিলে গুলি চালায়। এতে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রমিক নেতা মনু মিয়া, ওয়াজিউল্লাহসহ ১১ জন এবং নারায়ণগঞ্জে সফিক ও শামসুল হক নিহত হন। আহত হন অনেকেই।
সরকারের বিরূপ প্রচারণা ও অত্যাচারে ৬ দফা আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ৬ দফা যখন জনগণের ব্যাপক সমর্থন পায় ঠিক সেই সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে অভিযুক্ত করে এক নম্বর আসামি করা হয়। স্বৈরাচারী শাসকেরা ভেবেছিল মামলা দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিঃশেষ করে দেবেন। কিন্তু হলো তার বিপরীত। আগরতলা মামলা দায়েরের পর তিনি পরিণত হন মহানায়কে।
সরকারের যড়যন্ত্র ছাত্র যুক-জনতা ব্যর্থ করে দেয় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। প্রিয় নেতাকে তারা সেনানিবাসের কারাগার থেকে মুক্ত করে আসেন। মুক্তি পেয়ে লিনি তাঁর ও দফাভিত্তিক আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ৬ দফা দাবির সঙ্গে যেমন এদেশের মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করেছিল, ঠিক তেমনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে
তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে। যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ঐতিহাসিক দিনটি বাঙালির স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক, অবিস্মরণীয় একটি দিল। মুক্তিযুদ্ধের
প্রাক্কালে যেসব আন্দোলন বাঙালির মনে স্বাধীনতার চেতনা ও স্পৃহাকে ক্রমাগত জাগিয়ে তুলেছিল দফা আন্দোলন তারই ধারাবাহিকতার ফসল। এরই ধারাবাহিকতায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির অবিস্মরণীয় বিতায়, একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চের গণহত্যা এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পথ ধরে দেশ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর মাসের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ-যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের
দেশে উন্নীত হয়েছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ কার সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সব কিছুই সম্ভব হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। শহীদদের রক্ত বৃথা। যায় না। - তার প্রমাণ ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, বাঙালির বাঁচার দাবিও সফা আন্দোলন ও ৬৯-এর গণ আন্দোলন। যার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের পরাভূত করেন। বর্তমানে জাতির পিতার সুযোগ্যা কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গরত্ন শেখ হাসিনা জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমাদের সকলকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: সদ্য সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক মহাসচিব, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন।
তারেক