ঢাকা,

১৩ মার্চ ২০২৫


মহিউদ্দীন আহমদ: সৃজনশীল প্রকাশনার অগ্রপথিক

মোঃ আশিকুজ্জামান আশিক

প্রকাশিত হয়েছে: ১১:২৪, ১৩ মার্চ ২০২৫

মহিউদ্দীন আহমদ: সৃজনশীল প্রকাশনার অগ্রপথিক

বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, সৃজনশীল প্রকাশনার পথিকৃৎ ও আহমদ পাবলিশিং হাউসের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মহিউদ্দীন আহমদ।

আগামী ১৫ মার্চ এই কৃতি প্রকাশকের মৃত্যুবার্ষিকী, যিনি বাংলা ভাষার মানচিত্র বই, ওয়ালম্যাপ ও গ্লোব প্রকাশ করে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর এই প্রচেষ্টা কেবল ব্যবসায়িক উদ্যোগ ছিল না, ছিল দেশপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

ম‍্যাপ, গ্লোব ও চার্ট তৈরি করে তিনি দেশপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিলেন। এগুলো ভারত থেকে আমদানি করা হতো, এবং দেশের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত জেনারেল ওমরাও খানের সাথে সাক্ষাৎ করে এসমস্ত শিক্ষা উপকরণ ভারত থেকে আমদানি বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

শিক্ষা ও সমাজসেবায় অবদান

শুধু একজন সফল প্রকাশক নন, মহিউদ্দীন আহমদ ছিলেন এক নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক। তাঁর শৈশবের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চিনামুড়া হাইস্কুলের অবস্থা ছিল দুর্বল; তাই তিনি নিজ অর্থায়নে সেখানে একটি পাকা দালান নির্মাণ করে দেন। তাছাড়া, নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলতাফ মেমোরিয়াল ফ্রি প্রাইমারি স্কুল’ ও ‘স্বপাড়া দাতব্য চিকিৎসালয়’ (স্থাপিত ১৯৫৯ সালে), যেখানে অসহায় মানুষের জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হয়েছিল।

যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা

১৯৬২ সালে দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর-মতলব সড়ক নির্মাণে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯৬৯ সালে গৌরীপুর মুন্সি ফজলুর রহমান ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং কলেজের গ্রন্থাগার (মহিউদ্দীন পাঠাগার) ও ছাত্রাবাস নির্মাণ করেন।

প্রকাশনা ও জাতীয় স্বীকৃতি

তিনি ১৯৮৫ সালে প্রকাশনায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র স্বর্ণপদক অর্জন করেন। একই সালে সৃজনশীল প্রকাশনার স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে বাংলা একাডেমি সম্মাননা প্রদান করা হয়।

জাতি গঠনে শিশুদের কথা চিন্তা করে তিনি সুলভ মূল্যে একশত সিরিজ প্রকাশ করেন। দাম কম হওয়ায় এগুলো অনেক বিক্রি হতো। 'জীবনী সিরিজ' নামে এই বইগুলো খুবই জনপ্রিয় ছিল। এই অর্থে তিনি একজন ব্যতিক্রমী প্রকাশক ছিলেন।

একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব

প্রকাশনা শিল্পের ক্ষেত্রে তিনি শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যের প্রতীক ছিলেন না, ছিলেন শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির একজন নিবেদিত সংগঠক। শৃঙ্খলিত জীবনযাপন, শ্রমনিষ্ঠা ও মানবসেবার যে সমন্বয় তিনি করেছিলেন, তা তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল। জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, "মহিউদ্দীন আহমদ সমাজের সেই বিরল ব্যক্তিত্বদের একজন, যাঁর সঙ্গে যেকোনো বুদ্ধিজীবী সচ্ছল সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন।"

এক অনন্য পিতার স্মৃতিচারণ

তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ স্মৃতিচারণ করে বলেন, "একজন আদর্শবান ও সফল পিতার সন্তান হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, কিন্তু তাঁর আদর্শ ধারণ করা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরও কঠিন। আমার বাবার সাফল্যের মূল ভিত্তি ছিল শৃঙ্খলিত জীবন। প্রতিদিন ফজরের নামাজ শেষে সুর করে কোরআন তেলাওয়াত করতেন, যা আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকত।"

তিনি আরও বলেন, "অর্থবিত্তের মালিক হয়েও বাবা ছিলেন অত্যন্ত সরল জীবনযাপনের পক্ষপাতী। গাড়ি ব্যবহার করতেন, তবে নতুন মডেলের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না। পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পরিবেশই ছিল তাঁর পছন্দের আবাস।"

মুক্তিযুদ্ধে অবদান

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য নিজ উদ্যোগে একটি শান্তি ও শৃঙ্খলা কমিটি গঠন করেন। দুষ্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে দমন করে তিনি সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন। তাঁর নিরপেক্ষ বিচারের কারণে স্বাধীনতা পর্যন্ত এলাকায় কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়নি। 

চিরস্মরণীয় এক নাম

মহিউদ্দীন আহমদ ছিলেন সাদা পোশাকের এক মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। ন্যায়বিচার ও মানবসেবার কারণে তিনি সকলের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা আহাজারি করে বলেছিলেন, "আমাদের আর কেউ নেই।"

তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকুক।

 

মোঃ আশিকুজ্জামান আশিক
সাবেক শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

টিএইচ

News