
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম বলেন, তামাকবিরোধী সংস্থাগুলো সামাজিক সচেতনতা না বাড়িয়ে এনবিআরকে ভ্যাট বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে তামাক ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করেছে, যা সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
কারণ তামাক বিরোধী কার্যক্রমের মধ্যে একটি হলো, তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বাড়িয়ে সিগারেটের দাম বাড়ানো। অনেকের ধারণা, সিগারেটের দাম বাড়ালেই হয়তো তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমে আসবে। কিন্তু এই পদ্ধতি কাজ করছে না। এর কারণ সোশ্যাল চ্যারিটি , এক্টিভিটি গ্রুপে যারা কাজ করছেন, তারা সোশ্যাল মবিলাইজেশনে গিয়ে বলেছেন, ধুমপান নয়,পুরো শক্তিটাই তারা খরচ করেছেন এনবিআরের সাথে লবিং করে, সিগারেটের ট্যাক্স বাড়ানো, সিগারেট পানে ক্যান্সার হবে, প্যাকেটের গায়ে সেই ছবি থাকার দাবিতে।
বুধবার (১২ মার্চ ) সকাল ১১টায় ইকোনমিক রিপোর্টারস ফোরামের কার্যালয়ে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে তামাক পণ্যের কার্যকর কর ও মূল্য বৃদ্ধি বিষয়ক সাংবাদিক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম এ মন্তব্য করেন ।
কর্মশালায় বিশেষ অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (মূসক নীতি) ড. মোঃ আবদুর রউফ। সভাপতিত্ব করেন ডব়্প-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এএইচএম নোমান।
স্বাগত বক্তব্য দেন ইকোনমিক রিপোর্টারস ফোরামের সভাপতি দৌলত আকতার মালা। কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডব়্প-এর উপ-নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান। এছাড়া বক্তব্য দেন আজাহার আলী তালুকদার। কর্মশালাটি সঞ্চালনা করেন ইকোনমিক রিপোর্টারস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম। মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন সাংবাদিকবৃন্দ।
তামাকজাত পণ্যের কার্যকর কর ও মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে জাতীয় কনভেনশনের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন মোহাম্মদ শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, তামাক সেবন থেকে মানুষকে মুক্ত করতে ওরস্যালাইনের মতো তামাক বিরোধী কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে নতুন ইনোভেশন দরকার। ওরস্যালাইনের মতো আমরা এমন কিছু আবিষ্কার করবো যার ফলে বাংলাদেশ থেকে তামাকজাত পণ্য চিরতরে চলে যাবে। ট্যাক্স বাড়ানোর জন্য এনবিআরের দুয়ারে কড়া নাড়তে হবে না।
দৌলত আকতার মালা বলেন, সর্বশেষ পাঁচ অর্থবছরে তামাক বিরোধী নাগরিক সংগঠনের প্রস্তাব মতে কার্যকর করারোপ করা গেলে অন্তত ১১ থেকে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি রাজস্ব আয় করা সম্ভব হতো। তাই প্রস্তাবনা অনুসারে সিগারেটের দাম বাড়ানো গেলে সিগারেটের ওপর বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক হার (৬৭ শতাংশ) অপরিবর্তিত রেখেই আগামী অর্থবছরে চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৪৩ শতাংশ বেশি রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব।
তিনি আরো বলেন, তবে গবেষণা অনুযায়ী ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে তামাক থেকে যে রাজস্ব পেয়েছিল তার চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি টাকা তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারজনিত রোগের চিকিৎসা বাবদ খরচ হয়েছিল।
মূল প্রবন্ধে মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান বলেন , বর্তমানে বাজারে নিম্ন, মধ্যম, উচ্চ, ও অতি উচ্চ- এই চার স্তরের সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের এই দামবৃদ্ধির পরও সবচেয়ে সস্তা সিগারেটের একটি শলাকা ৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সিগারেটের সহজলভ্যতা কমাতে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রতি শলাকা সিগারেটের দাম অন্তত ৯ টাকা ধার্য করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সিগারেট বিক্রির সিংহভাগ প্রায় ৯০ শতাংশ নিম্ন এবং মধ্যম স্তরের দখলে রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মাথাপিছু সিগারেট বিক্রি বিগত বছরগুলোতে প্রায় একইরকম থাকলেও এই দুই স্তরে সিগারেট বিক্রি বেড়েছে। আসন্ন অর্থবছরে নিম্ন ও মধ্যম- এই দুটি স্তরকে একত্রিত করে এই নতুন তিন স্তরের সিগারেটের দশ-শলাকার একেকটির দাম যথাক্রমে ৯০ টাকা, ১৪০ টাকা, ও ১৯০ টাকা ধার্য করতে হবে। এই প্রস্তাবনা আগামী বাজেটে প্রতিফলিত করা গেলে প্রায় ১৭ লক্ষ তরুণ ধুমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে। দীর্ঘমেয়াদে প্রায় ৮ লক্ষ ৭০ হাজার তরুণ জনগোষ্ঠীর অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে।
মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বিভিন্ন নিত্য পণ্যের দাম বাড়ার সাথে সাথে সিগারেটের দাম বেড়েছে ব্রয়লার মুরগি ২৩.৫ শতাংশ, সয়াবিন তেল ২১.৪ শতাংশ, সিগারেট ১৭.৩ শতাংশ, চাল ১৬.৭ শতাংশ, মসুর ডাল ৪.৮ শতাংশ।
তিনি বলেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তামাক বিরোধী নাগরিক সংগঠন গুলোয় কয়েকটি প্রস্তাবনায় উঠে এসেছে , ২৪ লাখ ৪০ হাজারের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক ধূমপান ত্যাগ করতে পারেন, প্রায় ১৭ লক্ষ ১৭ হাজার কিশোর-তরুণকে নতুন করে সিগারেট ব্যবহার শুরু করা থেকে বিরত রাখা যেতে পারে, দীর্ঘমেয়াদে প্রায় ১৭ লক্ষ ১৩ হাজার অকালমৃত্যু রোধ করা যেতে পারে, সিগারেট বিক্রি থেকে রাজস্ব আসতে পারে ৬৯ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি।
ড. মোঃ আবদুর রউফ বলেন, তামাক নিয়ে এনবিআরের কোনো গবেষণা নেই। এটা আমাদের দুর্বলতা। সিগারেটের দাম বাড়ায় ধুমপায়ীর ক্রয় ক্ষমতার বাইরে গিয়ে ব্যবহার কমে যাবে। অর্থ উৎপাদনকারীর পকেটে চলে যায়। কর বাড়ালে সরকার লাভবান হয়।
এএইচএম নোমান বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে তামাকপণ্যে কর বৃদ্ধি ব্যয়-সাশ্রয়ী পদক্ষেপ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত সিগারেট কর সংস্কার একটি সুস্থ জাতি গঠনে অবদান রাখার পাশাপাশি দেশের দেশের স্বাস্থ্যখাত ও উন্নয়ন অগ্রাধিকারসমূহে অর্থায়ন এবং টেকসই কর ব্যবস্থার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অতিরিক্ত অর্থের যোগান দিবে।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, সর্বশেষ তিন অর্থবছরে জটিল মাল্টি-টায়ার্ড অ্যাড ভ্যালোরেম কর ব্যবস্থার কারণে সিগারেটের দাম বেড়েছে মাত্র ৭.৩ শতাংশ । অন্য নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির তুলনায় তা নগণ্য। এতে গড়ে সিগারেট বিক্রি বেড়েছে বছরে ৪ শতাংশ হারে। চলতি অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে সকল স্তরের সিগারেটর ওপর সমান ৬৭ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরে নিম্ন এবং মধ্যম স্তরকে একত্রিত করে প্রস্তাবিত নতুন স্তরে সিগারেটের প্রতি শলাকার দাম ন্যূনতম ৯ টাকা করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশে সিগারেট ব্যবহারের হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না।
টিএইচ