
টাঙ্গাইলে মানসিক ভারসাম্যহীনদের নিয়ে সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহেরের(ভিপি জোয়াহের) ছয়তলা ভবন দখল, ভাংচুর ও চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তারকৃত নারী সমন্বয়ক মারিয়াম মোকাদ্দেস মিষ্টিকে আদালত চার দিনের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) অনুমতি দিয়েছে।
সোমবার (১০ মার্চ) সকাল ১১ টার দিকে টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক গোলাম মাহবুব খান ওই অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের(রিমান্ড) আবেদন মঞ্জুর করেন।
এর আগে রোববার(৯ মার্চ) দিনগত রাত ১২টার দিকে টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম আকুরটাকুর পাড়া এলাকা থেকে মারিয়াম মোকাদ্দেস মিষ্টিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
আদালত ও পুলিশ সূত্র জানায়, টাঙ্গাইল সদর থানা পুলিশ মিষ্টিকে ৭ দিনের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের(রিমান্ড) আবেদন করে সোমবার সকালে আদালতে পাঠায়। পরে আদালতের বিচারক শুনানি শেষে চার দিনের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের(রিমান্ড) অনুমোদন দেন। গ্রেপ্তারকৃত মারিয়াম মোকাদ্দেস মিষ্টি বাসাইল উপজেলার জশিহাটী গ্রামের শাহ আলমাসের স্ত্রী। তবে তিনি বর্তমানে টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম আকুর টাকুর পাড়ায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন।
এর আগে শনিবার(৮ মার্চ) সকালে শহরের ছোটকালিবাড়ীতে অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহেরের(ভিপি জোয়াহের) ছয়তলা ভবনের তালা ভেঙে ১৭ জন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে নিয়ে সমন্বয়ক মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি ভবনে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীনদের জন্য আশ্রম বানানোর ঘোষণা দেন। বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে জেলাজুড়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এতে প্রশাসন নড়চড়ে বসে। ওইদিনই রাত সাড়ে ১০টার দিকে যৌথবাহিনী অভিযান পরিচালনা করে বাড়িটি দখলমুক্ত করে। সদর উপজেলা সহকারী কমিমনার (ভূমি) রুহুল আমিন শরিফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথভাবে ওই অভিযান পরিচালনা করে। পরে মুচলেকা দিয়ে রাতেই মিষ্টিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সমন্বয়ক মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি ‘মুচলেকা’য় লিখেন- ‘আমি আইনী অধিকার ব্যতিরেকে অন্যের ব্যক্তিগত বাড়িতে মানসিক ভারসাম্যহীন ১৭ জন নারী-পুরুষকে আবাসনের চেষ্টা করে অপরাধ করেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার পোস্টের কারণে ক্ষেত্র বিশেষে যে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে- তার দায়ভার আমার উপর বর্তায়। আমি আমার নেতিবাচক ও বেআইনি কৃতকর্মের জন্য মানবিক বিবেচনায় ক্ষমাপ্রার্থী। আমি এইমর্মে নি:শর্ত মুচলেকা সম্পাদন করছি যে, ভবিষ্যতে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয় এমন ফেসবুক পোস্ট করা এবং ব্যক্তিগত বা সরকারি সম্পাদ দখল বা ভাঙচুর করা সহ অন্য কোন প্রকার অপরাধে লিপ্ত হবোনা। আমি প্রদত্ত মুচলেকা ভঙ্গ করলে প্রচলিত আইনে আমার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলে তার বিপরীতে আমার কোন আপত্তি গ্রহনযোগ্য হবেনা।’ মুচলেকায় স্থানীয় চারজন যুবক ও সমন্বয়ক এবং তার স্বামী শাহ্ আলমাস সাক্ষী হিসেবে নাম-সাক্ষর করেছেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি ও দুই নারী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য হিসেবে জিহাদী বই নিয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার জোকারচর থেকে পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
সূত্রমতে, মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি(২৭) জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের নারী কমান্ডার হিসেবে পরিচিত। তিনি পাকিস্তানে চার মাস এবং মিয়ানমারে ১০ মাস গেড়িলা ট্রেনিং নিয়েছেন বলেও তার সহকর্মী নারীদের মধ্যে প্রচারণা রয়েছে।
জেলায় জুলাই আন্দোলন চলাকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমন্বয়ক হিসেবে মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টির নাম থাকলেও ওই কমিটি বাতিল করা হয়। পরে টাঙ্গাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে কমিটি গঠন করা হয়েছে সেখানে মিষ্টির কোন জায়গা হয়নি। তাছাড়া মিষ্টির সাম্প্রতিক কিছু কর্মকান্ডে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন অনেকটা বিব্রত।
এদিকে, রোববার রাত ১১টার দিকে মানসিক ভারসাম্যহীন ১৭ জনের মধ্যে ১৬ নারী মানসিক ভারসাম্যহীনকে গাজীপুরের কাশিমপুর সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে এবং দুই জন পুরুষ মানসিক ভারসাম্যহীনকে ময়মনসিংহের ধলা সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে একজন সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
অপরদিকে, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহেরের(ভিপি জোয়াহের) বাসায় ভাংচুর, লুটপাট, দখল ও ১০ কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে জোয়াহেরুল ইসলামের স্ত্রী রওশন আরা খান বাদী হয়ে রোববার রাতে সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়- শহরের আকুরটাকুর পাড়ার ছয়তলা ভবনের কলাপসিবল গেইটের ছয়টি তালা ভেঙে সমন্বয়ক মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টির নেতৃত্বে ৮-৯ জন পূর্বপরিকল্পিতভাবে ১৭ জন মানসিক ভারসাম্যহীন লোক নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে বাড়িটির দখল নেয়। এ সময় তারা ভেতরে লুটপাট চালায়। বাসার ভেতর থেকে তারা নগদ পাঁচ লাখ টাকা, ১০ ভরি স্বর্ণালংকার চুরি করে। এছাড়া প্রায় ৫০ লাখ টাকার আসবাবপত্র ভাংচুর করে। এ বিষয়ে মিষ্টিকে জিজ্ঞাসা করলে সে ১০ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে বাড়িটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
মামলা সূত্রে রোববার রাত ১২টার দিকে শহরের পশ্চিম আকুর টাকুর পাড়া এলাকা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সোমবার ৭ দিনের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের(রিমান্ড) আবেদন সহ তাকে আদালতে পাঠানো হয়। টাঙ্গাইল সদর থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) তানভীর আহমেদ জানান, মামলার পরিপ্রেক্ষিতে মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি নামে এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সোমবার সকালে তাকে সাতদিনের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের(রিমান্ড) আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত চারদিনের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের(রিমান্ড) অনুমতি দিয়েছেন। তার সঙ্গে আরও যারা জড়িত রয়েছে শনাক্ত করে তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুহুল আমিন শরিফ জানান, মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি নামে এক নারী সাবেক সংসদ সদস্যের বাসাটি অবৈধভাবে দখল করে মানসিক ভারসাম্যহীন ১৭ জন নারী-পুরষকে আবাসনের চেষ্টা করে। পরে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নেওয়া হয়। বাড়িটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অবৈধ দখলমুক্ত করা হয় এবং মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের উদ্ধার করা হয়। রোববার রাত ১১টার দিকে মানসিক ভারসাম্যহীন ১৭ জনকে মানসিক ভারসাম্যহীনদের ময়মনসিংহ ও গাজীপুরের সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত নারী অপরাধ করেছেন মর্মে মুচলেকা দিয়ে ক্ষমা প্রার্থণা করেন এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের অপরাধ করবেন না মর্মে প্রত্যয়ন দেন। মুচলেকায় তার স্বামীসহ মোট ৫ জন সাক্ষী স্বাক্ষর করেন। মানবিক বিবেচনায় ভুল শুধরে নেওয়ার একটি সুযোগ দিতে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে ওই বাড়ির মালিক থানায় মামলা দায়ের করলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
উল্লেখ্য, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের(ভিপি জোয়াহের) ২০১৮ সালে টাঙ্গাইল-৮(বাসাইল-সখীপুর) আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে তিনি আত্মগোপণে রয়েছেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর বাড়িটিতে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। তারপর থেকে বাড়িতে আর কোনো লোক দেখা যায়নি।
টিএইচ