জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ বলেছেন, দেশে ও দেশের বাইরে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। পাশের দেশে মিডিয়ায় আমার দেশ নিয়ে অতিরঞ্জিত করে সংবাদ উপস্থাপন করছে। তারা একটি ছোট ঘটনাকে বড় করে দেখাচ্ছে। সীমান্তে রক্ত ঝড়ছে, আমরা এ রক্ত চাই না।
আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ, কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছে। কিন্তু আমরা বন্ধুত্ব চাই সাম্য, ন্যায্য ও সমতার ভিত্তিতে।
শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ক্বণন শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গনের ৩৯ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
কবি হাসান হাফিজ বলেন, আমরা সীমান্তে ফেলানির মতো কোনো লাশ দেখতে চাই না।
আমরা সৎ প্রতিবেশী হয়ে উঠতে সমস্যাটা কোথায়? ভারত মেডিক্যাল ও পর্যটন ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। ঠিক আছে, আমাদের সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে। ভারতের কি সুবিধা হচ্ছে? সেখানেও প্রতিবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশে যদি পেঁয়াজ রপ্তানি না হয়, মহারাষ্ট্রের কৃষকরা আন্দোলন করেন।
আগে ভারত থেকে গরু আসতো। এখন আসে না। তাই বলে কি আমরা গরুর মাংস না খেয়ে আছি? আমরা পশু উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়েছি। পেঁয়াজ, আলু ও চিকিৎসা ক্ষেত্রেও আমরা স্বনির্ভর হবো। আমাদের এখন বিশ্বমানের চিকিৎসক আছে।
সময় এসেছে নিজেদের প্রমাণ করার।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম একটি আবেগের জায়গা। এটি আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার। এখান থেকেই সূর্যসেন, প্রীতিলতা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন। এছাড়া এখান থেকে শহীদ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আমি নিজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের ছাত্র ছিলাম। সেজন্য আমি গর্বিত বোধ করি। চট্টগ্রামের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঋণও আছে। কারণ, আজকের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ছোট ভাই মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক। তার হাত ধরেই আমি ১৯৭৬ সালে প্রতিবেদক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আমার দুই বার দেখা হয়েছে। আমি ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রামে ড. ইউনূসের ‘নিরিবিল’ বাড়িতেও এসেছিলাম। ড. ইউনূসের সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে ততবার বলেছি, আপনাদের বাথরুমগুলো অনেক বড় বড়। ড. ইউনুসও হেসে হেসে বলেছেন, আমাদের বাড়ির বাথরুমগুলো আসলেই অনেক বড়।
কালের কণ্ঠের সম্পাদক বলেন, আমি পাঁচ মাস আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবেব সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছি। আর কালের কণ্ঠের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি চার মাস হলো। জাতীয় প্রেস ক্লাবে যে আওয়ামী দোসররা ছিল, তাদের মধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এখন পালাতক। আপনারা জানেন, উচ্চ আদালতে যেদিন ছাত্ররা অবরোধ করেছিলেন, সেদিন ১১ জন সমন্বয়ন জাতীয় প্রেস ক্লাবেও এসেছিলেন। তারা স্মারকলিপি দেন, যাতে আওয়ামী দোসর সাংবাদিকদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ইতোমধ্যে আমরা জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে অনেককে স্থায়ী ও সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেছি।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি বলেন, এখনো গণমাধ্যম দোসরমুক্ত হয়নি। আমাদের দেশের ছাত্র-জনতা যে প্রাণ দিয়ে দোসর মুক্ত করেছে। বহি:বিশ্ব সেটাকে বিপ্লব বলতে চায় না। আমি জুলাই বিপ্লবই বলি। কারণ, আগের মতো চীন বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব ও রুশ বিপ্লব হবে না। বিপ্লবের সংজ্ঞাটা বদলাতে হবে। কারণ, রাজনীতি বদলে গেছে। আমরা দেখেছি, ৫ আগস্ট লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। তারা জানে, তাদের সামনে মৃত্যু। এরপরও তারা দোসরকে তাড়াতে রাস্তায় নেমেছেন, শুধু ১৬ বছরের শোষণ থেকে মুক্তির আশায়।
তিনি আরো বলেন, এসব দোসররা দেশ থেকে সম্পদ লুটে নিয়ে গেছেন। গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ এমন কি তারা করেননি। এসব আগামীতে আর হতে দেওয়া যাবে না। তাই গণমাধ্যমকে সতর্ক থাকতে হবে। তা নাহলে আমাদের ছাত্র-জনতার এ বিপ্লব সফল হবে না। কারণ, আমরা প্রাথমিক চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়েছি। মূল চ্যালেঞ্জ সামনে। ওই চ্যালেঞ্জেও আমাদের জয়ী হতে হবে। আমাদের এ বিজয়টা আরও শক্ত করতে হবে। আগে আমি গণমাধ্যমে কথা বলার জন্য যেতাম না। কারণ, দোসরদের কারণে কোনো কথা বলা যেত না। এখন আমি গণমাধ্যমে যাচ্ছি, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করছি।
চট্টগ্রামের বিষয়ে কবি হাসান হাফিজ বলেন, চট্টগ্রামের মানুষের অনেক দায়িত্ব আছে। এটি আমাদের বাণিজ্যিক রাজধানী। এ চট্টগ্রাম আন্দোলনের সূতিকাগার বলব। এ ছাড়া চট্টগ্রাম শহর ঢাকার থেকে অনেক সুন্দর। অনেক গাছ আছে, পাহাড় আছে। এরপরও চট্টগ্রাম যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে না নানান ক্ষেত্রে। এটা চট্টগ্রামের মানুষের ব্যর্থতা বলব না। এটা মূলধারা লোকদেরই ব্যর্থতা। আমরা চাইব সবাই মিলে দেশটা এগিয়ে নিয়ে যায়।
বক্তব্য শেষে শ্রোতাদের অনুরোধে কবি হাসান হাফিজ তার নিজের কবিতা ‘টেরাকোটা’ ও ‘মুগ্ধ জেগে আছি’ আবৃত্তি করেন।
ক্বণন সভাপতি ও আবৃত্তি শিল্পের শিক্ষক মোসতাক খন্দকারের সভাপতিত্বে এবং ক্বণন কার্যকরী পরিষদ সদস্য আবৃত্তি শিল্পী শরীফ মাহমুদ ও শুভ্রা চক্রবর্তীর সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন- জেলা পরিষদ চট্টগ্রামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল, কোলকাতার খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী ও প্রশিক্ষক শাশ্বতী গুহ এবং চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব ও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার চট্টগ্রামের আবাসিক সম্পাদক জাহিদুল করিম কচি। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ক্বণন কার্যকরী পরিষদ সদস্য সৌভিক চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে ক্বণনের শিশু-কিশোর সদস্যদের পরিবেশনায় আবৃত্তি শিল্পের শিক্ষক মোসতাক খন্দকারের গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় 'বাংলাদেশের মুক্তি' শীর্ষক বৃন্দ আবৃত্তির মঞ্চায়ন হয়। এতে অংশগ্রহণ করে মেহজাবিন, সামিহা, নাবিলা, নওশিন, সমৃদ্ধ, মুবাশিশরা, রেঁনেসা, আফরিন, জারিফ, নুসাইবা। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন সৌভিক চৌধুরী, শরীফ মাহমুদ, শুভ্রা চক্রবর্তী, সুস্মিতা চৌধুরী, ইব্রাহিম মাহমুদ, মুনযিম আসরা ও রাইয়ান রহমান। এরপর দ্বৈত আবৃত্তি পরিবেশন করেন আমন্ত্রিত শিল্পী কোলকাতার জনপ্রিয় আবৃত্তি শিল্পী শাশ্বতী গুহ ও ক্বণন সভাপতি মোসতাক খন্দকার। সংগীত পরিবেশন করে শ্রাবন্তী ঘর ও কৌশিক দত্ত।
অনুষ্ঠানে কবি হাসান হাফিজ, জেলা পরিষদ চট্টগ্রামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল, কোলকাতার খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী ও প্রশিক্ষক শাশ্বতী গুহ এবং চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার চট্টগ্রামের আবাসিক সম্পাদক জাহিদুল করিম কচিকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। সম্মাননা তুলে দেন ক্বণন সভাপতি মোসতাক খন্দকার। এই আয়োজনে ৭৫তম কর্মশালা সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীদের মাঝেও সনদ তুলে দেন কবি হাসান হাফিজ।
টিএইচ