
এ দেশের মানুষের স্বাধীনতার প্রথম অনুপ্রেরণা ছিল ভাষা আন্দোলন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ঘোষণা দেন।
এর তিন দিন পর, ২৪ মার্চ, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক ভাষণে আবারও একই কথা পুনরাবৃত্তি করে বলেন— “The state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Anyone who tries to mislead you is really the enemy of Pakistan.”—(মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ) এ কথা শুনে হলরুমে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা চিৎকার করে বলেন— “না, না!”— “বাংলা চাই!” শিক্ষার্থীরা সেদিন জিন্নাহর সম্মুখে তার কথার বিরোধিতা করে বুঝিয়ে দিলেন— হ্যাঁ, আমরা পাকিস্তানের শত্রু! এটাই ছিল এ দেশের মানুষের প্রথম প্রতিবাদ।
১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে স্বাধীন হয়েছি কতবার, এর কি কোনো হিসেব আছে? কিংবা কত মানুষ প্রাণ দিয়েছে! ১৯৫২-এর রফিক প্রিয়তমার জন্য কিনেছিলেন বেনারসি লাল শাড়ি, পায়ের আলতা, লাল লিপস্টিক আর লাল টিপ। প্রেমিকার প্রেমকে তুচ্ছ করে বাংলার মাটিকে লাল করে দিয়ে গেছেন তিনি। ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের গভীর রাতে পুলিশ যদি জিজ্ঞাসা করত—“এত রাতে কী কর?”— উত্তরে বাবুলরা বলত—“চিকা মারছি, স্যার!” বাবুল তার তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রের গ্রাফিতি এঁকেছিল। ১৯৬৬-এর ছয় দফায় মনু মিয়ার বাবা ঢাকায় এসে বারবার আর্তনাদ করে বলেছিলেন— “আমার পোলার লাশটা দাও, বাবারা! ঘরে নিয়া যাই!” মনু মিয়াকে পাওয়া যায়নি।
মনু মিয়া বাংলার বাতাস হয়ে গিয়েছিল। তেমনি— ১৯৬৯-এর শহীদ আসাদ,১৯৭১-এর মুনীর চৌধুরী, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে শরীরে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখা নূর হোসেন,২০২৪-এর আবু সাঈদের মতো আরও কয়েক লক্ষ মানুষ। ভাষা রক্ষা, স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পতন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র রক্ষা, স্বৈরাচার এরশাদের পতন, স্বৈরাচার হাসিনার পতন— কত স্বাধীনতাই না পেলাম! স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারলাম কই? বারবার স্বাধীনতা অর্জনের পর কোনো এক অদৃশ্য শক্তি এসে নিয়ে যেতে চায় ২৫শে মার্চের ভয়াল রাতের মতো জঘন্য স্থানে। আর আমরা? নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে সব দেখে যাই! ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেশের নামে আত্মত্যাগ করা সেই বীরেরা যদি ফিরে এসে আর্তনাদ করে, হায় হায় করে যদি বলে ওঠে— “আমাদের রক্ত কি বৃথা গেছে?” তখন কী উত্তর দেবে সোনার বাংলার নির্লজ্জরা? এই জাতি বারবার প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, কিন্তু রক্তে মিশে গেছে নিপীড়িত হওয়ার প্রবণতা! আরব, তুর্কি, মঙ্গোলীয়, মুঘল, ব্রিটিশরা এসে তো রীতিমতো জেনেটিক বৈচিত্র্য স্থাপন করে গেছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকলেই প্রতিবাদী এ জাতি স্বাধীনতা উন্মেষণ করে আবার নিজেদের তুলে দেয় নতুন শোষকদের হাতে।
যাদের মধ্যে ছিল সবসময়ই রক্ত চোষার প্রবণতা! জাতি শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়াবে ভেবে গুপ্ত শাসক কুমারগুপ্ত নির্মাণ করেছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। আশা ছিল জাতির সূর্য সন্তান তৈরি হবে, কিন্তু অভাগা জাতির কপালে জুটল দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, সম্পদ লুণ্ঠনকারী! শিক্ষিতরা দেশটাই বেচে দিল! সত্যেন সেনের “মূর্খের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়” প্রবন্ধে সমাজের সাধারণ মানুষ শিক্ষা, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার গুরুত্ব বোঝে না।শিক্ষা মানে অর্থ-বিত্ত, প্রাচুর্য, ক্ষমতা না ভেবে শুধুমাত্র মস্তিষ্কের উন্নয়ন ভাবা যেদিন শুরু হবে, সেদিনই জাতি উন্নতি করবে। সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর! ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা করেছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট স্বৈরাচাররা করেছিল শিক্ষার্থী হত্যা।এই হত্যাযজ্ঞ কোনোটিই একে অপরের চেয়ে কম নয়।
জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনা যারা করেছিল, দিন শেষে তারাই হারিয়ে গিয়েছে।এই শহীদদের রক্তের শপথ নিয়ে আসুন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি নিই! গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, ন্যায্য অর্থনীতি, সামরিক শাসন থেকে মুক্তি, ধর্মীয় স্বাধীনতা, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন।এই হোক শহীদদের দেওয়া রক্তের মর্যাদা, এই হোক মা-বোনের হারানো সম্ভ্রমের প্রতিশোধ! দেনা-পাওনার হিসেব না করে দেশপ্রেমকে ঈমানের অঙ্গ ভেবে আসুন, নতুন করে বাংলাদেশ গড়ি!দেশধর্ম পালনে আমরা হই সর্বশ্রেষ্ঠ মুমিন! আসুনশপথ করে বলি— “এ দেশ আমার, এ মাটি আমার, এ মানচিত্র আমার— মা!”
তারিকুল ইসলাম তারেক
শিক্ষার্থী,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
টিএইচ