২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রেও পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। গত ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের ৫৯ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ৬ নভেম্বর ভোরে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়, যেখানে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি বিজয়ী হয়ে পুনরায় সিনেটের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে। বিজয়ী প্রার্থী তথা ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা অনুষ্ঠিত হবে ২০২৫ এর ২০ জানুয়ারি।
দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প প্রশাসনের কূটনৈতিক নীতি এবং “ আমেরিকা ফার্স্ট” মনোভাব আবারো দৃশ্যপট হতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মিত্র দেশের জন্য সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ দুই ই বয়ে আনবে বলে ধারণা করা হয়। তবে বাংলাদেশের জন্য এই নতুন প্রশাসনের প্রভাব কী হতে পারে, তা বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ইতিবাচক এবং চ্যালেঞ্জপূর্ণ উভয় দিক থেকেই পর্যালোচনা করা যেতে পারে, যেখানে নিরাপত্তা সহযোগিতা, বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং অভিবাসন নীতির মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
ট্রাম্প প্রশাসন সাধারণত জাতীয়তাবাদী অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করে থাকে, যার মাধ্যমে আমেরিকান পণ্য উৎপাদন এবং স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহিত করা হয়। ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর তার “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির পুনরাবৃত্তি দেখা যেতে পারে, এর ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি বিশেষ করে পোশাক শিল্পে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রধান বাজারগুলোর মধ্যে অন্যতম,তাই আমদানি শুল্ক বা শুল্ক নীতির পরিবর্তন এই খাতকে প্রভাবিত করতে পারে। তাছাড়া ও ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে বাণিজ্য চুক্তিতে কড়া শর্ত থাকতে পারে, যা বাংলাদেশকে আরো প্রতিযোগিতার মুখে ফেলতে পারে।
তবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিবাদমান বাণিজ্য প্রতিযোগিতার ফলে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চীনের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে অনের আমেরিকান কোম্পানি চীনের বিকল্প হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে ঝুঁকতে পারে, যার মধ্যে বাংলাদেশ একটি সম্ভাব্য গন্তব্য। বাংলাদেশ যদি নিজের উৎপাদন মান উন্নত করতে পারে এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা চালু করে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ধরে রাখতে ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে পারে। বিশেষ করে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে একটি কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে সামরিক ও প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে আসছে। ২০১৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সামরিক আধুনিকীকরণের জন্য উল্লেখযোগ্য অর্থ বরাদ্দ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে $৬৬.৯ মিলিয়ন বিদেশি সামরিক সহায়তা ( FMF) এবং $৭.২৯ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক সামরিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (IMET)।
এছাড়াও উল্লেখযোগ্যভাবে, যুক্তরাষ্ট্র ৫০ টি মাইন রেজিস্ট্যান্ট যানবাহন ( MRAP) বাংলাদেশকে মালি শান্তিরক্ষা বাহিনীর জন্য প্রদান করেছে। যদি ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় থেকে চীন বিরোধী অবস্থান বজায় রাখে,তাহলে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আরও বেশি নিরাপত্তা সহায়তা দিতে চাইতে পারে। তবে, বাংলাদেশকে এই সহযোগিতার দিকে মনোযোগ দেওয়ার আগে ভারতের সাথে সম্পর্কও বিবেচনা করতে হবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের পূর্বের সময়ে অভিবাসন নীতির কঠোরতা অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপর প্রভাব ফেলেছিল। ট্রাম্প ক্ষমতায় পুনরায় এই নীতিতে কড়াকড়ি আরোপ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা, কাজ বা স্থায়ী বসবাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরুণ এবং দক্ষ জনগোষ্ঠী বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। বিশেষ করে, এইচ-১বি ভিসা বা অন্যান্য কর্মসংস্থান ভিত্তিক ভিসার ক্ষেত্রে কঠোর শর্ত আরোপ হতে পারে। তাছাড়া অভিবাসন সংক্রান্ত আইন এবং সীমান্ত নিরাপত্তা ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসন কড়া অবস্থান নিতে পারে, যার ফলে বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে নতুন বসতি স্থাপন আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।। তবে এমন পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ নিজস্ব দক্ষ শ্রমাবাজারে ফিরে আসা তরুণদের উপযুক্ত কাজে নিয়োগের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। তবে, ট্রাম্প প্রশাসনের পূর্বের নীতির মতো এবারও জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে উদাসীনতা দেখা যেতে পারে।ট্রাম্পের আগের প্রশাসন “প্যারিস জলবায়ু চুক্তি” থেকে বের হয়ে এসেছিল এবং তার নির্বাচিত হওয়া এই ধরনের সিদ্ধান্তের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যেতে পারে, যা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য উদ্বেগের বিষয়। জলবায়ু তহবিল এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কমে গেলে বাংলাদেশ নিজস্ব সংস্থান ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে হতে পারে। তবে, চীন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সাথে এই ইস্যুতে সম্পর্ক আরও উন্নত করে বিকল্প সহায়তা আনার চেষ্টা করতে পারে বাংলাদেশ।
ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চিত হলেও কিছু সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশ – যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নানাদিক দিয়ে ইতিবাচক থাকলেও চীন এবং ভারত এই দুই প্রভাবশালী শক্তির কারণে বাংলাদেশকে ভারসাম্য বজায় রাখতে হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের বিরোধী হলেও বাংলাদেশ চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী।
তাই বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে নিজস্ব অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বিশ্ববাজারে স্থান করে নেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয়তাবাদী নীতি, অভিবাসন নীতির কঠোরতা এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে উদাসীনতা এই সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই পরিবর্তনগুলোকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দক্ষতা এবং বহুমুখী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষমতার কোন বিকল্প নেই।
ফারিহা রহমান মীম
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
টিএইচ