ফাইল ছবি
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রায় প্রতিদিনই নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও মিছিলসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি রাজধানীসহ সারাদেশে দেখা গেছে। এসব কর্মসূচির বাইরে বিভিন্ন পক্ষ জড়িয়েছে সংঘর্ষ-সংঘাতেও।
এসময় এসব বিশৃঙ্খলা, সংঘাত ঠেকাতে কঠোর অভিযানে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পাশাপাশি নিরাপত্তা ও সাধারণ মানুষদের সচেতনতা বাড়াতে প্রতিটি থানায় পুলিশ, ছাত্র-জনতা ও নাগরিকদের সমন্বয়ে করা হচ্ছে মতবিনিময় সভা।
তবে এসব বিষয় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর হওয়ায় কিছুদিন শান্ত থাকলেও ফের উত্তপ্ত হতে দেখা গেছে বিভিন্ন গ্রুপকে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফের জড়িয়েছে সংঘর্ষে, ঘটেছে হতাহতের ঘটনা। এছাড়া ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত, দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করেও নিরাপত্তা-ব্যবস্থা অবনতির কথা উঠে আসছে বিভিন্ন মহল থেকে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এদেশের প্রেক্ষাপটে অপরাধ পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব না, তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় যেসব বাড়তি উদ্যোগ পুলিশের পক্ষে থেকে নিতে আগে দেখা গেছে সেরকম এখন আর দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে এখনও পুলিশের রয়েছে সমন্বয়হীনতা।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে পুলিশের পক্ষে থেকে বলা হচ্ছে, অপরাধের ধরণ সবসময় একই মাত্রায় থাকে না। কখনও কমে, আবার কখনও বেড়ে যায়। অপরাধ যেভাবেই ঘটুক না কেন পুলিশের কাজ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা। আর পুলিশ সেই কাজটিই করছে। যদি কেউ পরিকল্পিতভাবে কোনও শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করতে চায়, অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়, কোনও দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতে চায় তাহলে পুলিশ শক্ত হাতে তা মোকাবিলা করবে। সেটা যেকোনও দল হোক অথবা দুষ্কৃতকারী হোক, যে কেউ হোক, পেছনে যেই থাকুক কেউ ছাড় পাবে না।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পূর্বাচলের ৩০০ ফিট এলাকায় প্রাইভেটকারের ধাক্কায় মোতাসিম মাসুদ (২২) নামে বুয়েটের এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। পরদিন শুক্রবার এক মানববন্ধনে এ দাবি করে অভিযুক্তের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতসহ ছয় দফা দাবি জানান তারা। এছাড়া কাছাকাছি সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অস্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলপর্যায়ের এসব শিক্ষার্থী ‘গুপ্ত হত্যার’ শিকার হয়েছেন বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক কমিটি ও ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো। এ ধরনের মৃত্যুগুলোকে চিহ্নিত করে ‘হত্যাকারীদের’ বিচারের আওতায় আনার দাবিতে এরই মধ্যে রাজপথে নেমেছে বেশ কিছু সগঠন।
এই সকল গুপ্তহত্যা, চোরাগোপ্তা হামলা ও হুমকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বরাবর একটি লিখিত আবেদন করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। তারা উল্লেখ করেন, কিছুদিন যাবত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ফ্যাসিবাদী সরকার পতনের দাবিতে জুলাই বিপ্লবে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী ছাত্র-জনতার ওপর ফ্যাসিবাদের দোসর কর্তৃক সারা দেশে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হামলার ঘটনা ও ফোনকলে হুমকির ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর দৃশ্যত নিষ্ক্রিয় ভূমিকা জনমনে সংশয় তৈরি করেছে এবং ফ্যাসিবাদের দোসরদের সাহস জোগাচ্ছে। এমতাবস্থায় আমরাও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং মনে করছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষত পুলিশ বাহিনীর এই বিষয়ে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি মুখপাত্র সামান্তা শারমিন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের যোদ্ধারা প্রাণনাশের হুমকি, হামলা ও হত্যার শিকার হচ্ছেন। এ হত্যাকাণ্ডগুলোর ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আত্মপ্রকাশের পর থেকেই জাতীয় নাগরিক কমিটি বলে আসছে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মানুষের জানমাল রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও এমন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আমরা উদ্বিগ্ন। নতুন বাংলাদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নাগরিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাই।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার দিনেদুপুরে রাজধানীর কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া পাকাপোল এলাকায় রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় ঢুকে ডাকাতির ঘটনায় বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের এলাকাবাসীরা। খেলনা পিস্তল নিয়ে শিশু-কিশোররা যে এমন দুর্ধর্ষ কাজ করতে পারে, তা ভেবে হতাশ অনেকে।
স্থানীয়রা এমন ঘটনায় হতাশার সাথে সাথে ক্ষোভের কথাও জানান। তাদের প্রশ্ন, এত এত গ্রাহক-ব্যাংক কর্মকর্তাদের জিম্মি করে তারা টাকা লুট করতে থাকলো অথচ প্রতিরোধ কেউ করলো না!
তাছাড়া, গত ১৮ ডিসেম্বর গাজীপুরে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীদের মধ্যে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় চার জনের মৃত্যুসহ উভয় পক্ষের অনেকে আহত হয়েছেন। গাজীপুরের টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি যতদিন পর্যন্ত রাজনীতিমুক্ত না হবে ততদিন এই সমস্যা মিটবে না।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনায় পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে, অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনতে পুলিশ কাজ করছে। এসব ঘটনার জড়িত ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেছনে কোনও গোষ্ঠী কাজ করছে কিনা জানতে চাইলে পুলিশের এআইজি আরও বলেন, আমরা পরিষ্কারভবে বলতে চাই যদি কেউ পরিকল্পিতভাবে কোনও শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করতে চায়, অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়, কোন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে চাই তাহলে পুলিশ তা শক্ত হাতে মোকাবিলা করবে। সেটা যেকোনও দল হোক অথবা দুষ্কৃতকারী হোক, যে কেউ হোক, পেছনে যেই থাকুক কেউও ছাড় পাবে না।
গত বৃহস্পতিবার আইনশৃঙ্খলা এবং সার্বিক পরিস্থিতির এক সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘পুলিশ বাহিনী পুরোদমে কাজ শুরু করেছে। শুধু নির্বাচন নয়, যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে পুলিশ বাহিনী।’ ইজতেমা ময়দান এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। সেখানে সংঘাতের ঘটনায় তদন্ত চলছে। টঙ্গী ইজতেমার মাঠে যারা অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা করেছে তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’
টিএইচ